
এখনো রেলওয়েতে নিয়োগ বানিজ্য নিয়ে একটি বিভাগীয় তদন্ত এবং দুদকের আওতায় আরেকটি তদন্ত চলছে। নিয়োগ পর্যালোচনা কমিটি প্রতিবেদন দিবে আরো ২ সপ্তাহ পরে, ইতিমধ্যেই তারা অনিয়মের দেখা পেয়েছেন। এদিকে কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁসকারী ড্রাইভার আলী আজমকে এখনো কেউ খুঁজে পায়নি। উনি আত্মগোপনে আছেন নাকি তথ্য-প্রমান লুকাতে কেউ তাকে গুম করে রেখেছে জানা না গেলেও সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম বিবেচনায় কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছে।
আলী আজমের বক্তব্য ছাড়াই রেলওয়ের একটি কমিটি সেদিন তাদের প্রতিবেদন জমা দিল এবং জানিয়ে দিল প্রাক্তন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু এই ৭০ লাখ টাকার সাথে সংশ্লিষ্ট নন। এটা তার প্রাক্তন এপিএসের টাকা। সেই রাতে মাইক্রোবাসে থাকা রেলওয়ের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং যেসব বিজিবি অফিসার ও জওয়ান তাদের দেখাছিল এবং গাড়ি থামিয়ে ৪জনকে সে রাতে পিলখানায় রেখেছিল তারা কেউই জানতেন না গাড়িতে টাকা আছে। ড্রাইভার বলার পরেও তারা নাকি টাকা চেক করে দেখেনি। বিজিবি’র লোকজন (প্রায় ৮জন) একই লিখিত বক্তব্য এবং মৌখিকভাবে একই কথা বলেছেন তদন্ত কমিটির কাছে। বাহ! কি ঐক্য!
রেলওয়ের মহাপরিচালকের তত্বাবধানে করা এই তদন্ত কতটা স্পষ্ট-ন্যায় হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া সেইরাতে এই ঘটনায় নাকি বিশেষ বাহিনীর কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাদের বিষয়টা যে কে দেখবে কে জানে, তবে জনগনকে যে বিশেষ কিছু জানতে দেয়া হবেনা, সেটা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার। এই কমিটি তো মন্ত্রী সাহেব নিজেই করেছিলেন। তার উপর মহাপরিচালক বললেন সেই টাকা কোথা থেকে আসলো সেটা দেখা নাকি এই কমিটির আওতায় পড়েনা। হাস্যকর!
তাছাড়া সুরঞ্জিত বাবুর ছেলে সৌমেন্দ্র কিভাবে ৫ কোটি টাকার লাইসেন্স পেলো সে বিষয়টিও এখনো মিটিমাট হয়নি। দুদক খতিয়ে দেখছে বিষয়টি।
সুরঞ্জিত বাবুর মন্ত্রীত্ব পদত্যাগের পত্র সাক্ষর করার সাথে সাথেই চলে গেলেও প্রধানমন্ত্রী তাকে পরের দিন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বানালেন (দুর্নীতিকে উস্কে দিতে)। কিন্তু পরে তিনি বলেন সুরঞ্জিতের পদত্যাগপত্র যেহেতু রাষ্ট্রপতি গ্রহন করেননি তাই সেটা নাকি পদত্যাগ হয়নি। অতঃপর সংবিধান বিশেষজ্ঞরা তার এই ভুল ধরিয়ে দেন।
এরই মধ্যে সুরঞ্জিত বাবুর নিজ নির্বাচনী এলাকার প্রতি টান বেড়ে গেল। এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে তিনি গতকাল সিলেট গেলেন (তার নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জে) একটি দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে। সম্প্রতি সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইফতেখার হোসেন শামীমের মৃত্যুতে আয়োজিত শোকসভায় যোগ দিলেন। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
বাসায় প্রেস-কনফারেন্স করে বললেন তিনি রাজনীতিতে আসছেন আবার। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন সিলেট থেকে ফিরে। উনি যদি মন্ত্রী পরিষদে কোন দায়িত্ব দেন তবে তা সাদরে গ্রহন করবেন।
খুব স্বাভাবিক। ৫৫বছর রাজনীতি করে জীবনে প্রথমবারের মত মন্ত্রী হলেন। কিন্তু শান্তি পেলেন না বা তাকে বিপদে ফেলা হলো। এবার ফেরার সুযোগটা তাই হাতছাড়া করতে চাইলেন না। কেমন যেন, হা-ভাতে আচরন মনে হলো। নিজেকে যদি ধোঁইয়া তুলশীপাতা ভাবতে ভালো লাগে তবে তার এপিএস যে বহুদিন আগে থেকেই দুর্নীতির সাথে জড়িত সেটা স্বীকার করে নিলেই হত। পূর্ব জোনের মহাপরিচালক মৃধা যে নামকরা দুর্নীতিবাজ সেটা কেন সময় থাকতে বলেননি? একজন মন্ত্রী হয়ে যদি তিনি তার এত কাছের লোকেরা চুরি করছে সেটাই না জানেন তাহলে তার আবার সেই পদে বসার কি যোগ্যতা তার অবশিষ্ট রইলো?
মন্ত্রী হবার আগে তো উনি নিজেই বিসিএস ভাইভা, এবং সরকারি অন্যান্য নিয়োগ, পদন্নোতি ও বদলীর ব্যাপারগুলো দেখে টু-পাইস কামাতেন। তারপর দায়িত্ব হস্তান্তর করে দেন এপিএসের (আরো কেউ থাকতে পারে) উপর।
সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত সুরঞ্জিত বাবু কিন্তু খুব সাধারন মানুষ নন, বরং তেজী-রাগী বলে তার পরিচিতি আছে এবং এলাকার কেউ কেউ (নিন্দুকেরা) সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় জমি ও জলমহাল দখল কাজে তার দক্ষতার কথা বলে। অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে গতবছর গলাফাটানো সুরঞ্জিত এই আইন যেদিন পাশ হয় সেদিনই মন্ত্রী হন। তাই তাকে আর এ বিষয়ে কোন কথা বলতে শোনা যায়নি। চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর বিশাল অনুষ্ঠানে সেই আইনকে ঢেলে না সাজালে রাস্তায় নামবেন বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। যা ছিল তাই পাশ হয়েছে, তার দাবি মেনে নেয়া হয়নি, কিন্তু তাকে একটি ললিপপ ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেউ কেউ বলেন সরকারের প্রথম ৩ বছর বহু বড় বড় ডায়লগবাজি করেছেন বলে কঠিন একটি কাজ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। আবার, মন্ত্রী হবার পর তিনি নাকি আবুল হোসেনের পুরান গুদামে হাত দেয়ায় কারো কারো টাকা খেতে সমস্যা হচ্ছিল, তাছাড়া নানামূখী পদক্ষেপ (রেলওয়ের বেদখল জমি উদ্ধার, তেলচুরি বন্ধ ইত্যাদি) নিতে শুরু করায় দলীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল।
তাছাড়া ঘটনার দুদিন আগে, সরকারের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তিনিই প্রথম সাতক্ষীরায় ২টি গ্রামে জামাত-শিবিরের প্ররোচনায় হিন্দু পরিবারের উপর নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে ঘটনাস্থলে গিয়ে সবকিছু জেনে সংসদকে অবহিত করতে বলেন। কেউ কেউ বলছে, সরকার যা লুকাতে চায় তা সুরঞ্জিত বাবু প্রকাশ্যে বলে ফেলায় সরকারের একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, সাতক্ষীরায় ঘটনাগুলি ঘটে মার্চের শেষভাগে, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়াতে ঢাবি’র জগন্নাথ হলের ছেলেপুলেরা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আলোচনা সভায় অতিথি সুরঞ্জিতের কাছে প্রতিকার চাইলে তিনি দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী+প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশনা দেন। আরো উল্লেখ্য যে, সরকার ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া হাট-হাজারির ঘটনাতেও নিশ্চুপ ছিল (যেন অসাম্প্রদায়িক এই দেশের কোথাও হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোনই সমস্যা নেই)।
যাকগে, টাকা’টার কথায় আসি, অনেক বড় অঙ্কের টাকা। মৃধা হয়তো অন্তত নিয়োগ বানিজ্যে যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্যেই ৭০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন মন্ত্রীকে। তবে প্রায় ৩৮০০ লোকের নিয়োগের জন্য যদি ৯০ভাগ চাকরিপ্রার্থী ৪-৮ লাখ টাকা দিয়ে করে থাকেন তাহলে বুঝা যায় আনুমানিক কত টাকার লেনদেন হয়েছে এই মহা-নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়া স্থগিত করা হলেও সম্প্রতি এই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরেক শেষবেলার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন রেলওয়েতে আরো ১১,০০০ নিয়োগ দেয়া হবে!
হ্যা, বলছিলাম সুরঞ্জিত বাবুর নতুন করে জেগে উঠা ক্ষমতার লোভের কথা, যার জন্য তিনি তদন্ত শেষ হওয়া নাগাদ অপেক্ষা করতে পারলেন না, নাকি গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে? ইলিয়াস-হিলারি-প্রনব-তত্বাবধায়কের চাপে সুরঞ্জিত ইস্যু খানিকটা ছোট হয়ে যাওয়াতেই মনে হয় এই সিগন্যাল।
সরকারের কাছে এই মুহুর্তে সুরঞ্জিত বাবুর কামব্যাক গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু একজন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগার হিসেবে এবং তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত ছিলেন বলে সাধারন মানুষের কাছে তার উপর যে আস্থা ছিল তা ছত্রখান হয়ে গেছে মাইক্রোবাস চালকের দৃঢ়টা বা তাদের ভাষায় ‘মীরজাফরী’র জন্য। সেই ক্ষত ঠিকমত না শুকাতে দিয়েই উনি আবার চলে এলেন লাইম-লাইটে; সম্ভবত আরেকটা দূর্যোগ অপেক্ষা করছে তার জন্য।
দূর্যোগের কথা বললাম তার গতকালের বক্তৃতার কথা শুনে। প্রথম আলো থেকে উদ্ধৃত করছিঃ “সিলেটবাসীর জন্য এখন ক্রান্তিকাল চলছে। জননেতা আবদুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, এম সাইফুর রহমান থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ নেতা শামীমকে আমরা হারিয়েছি। সামপ্রতিক সময়ে এম ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন। রাজনীতিতে একটা শূন্যতার জায়গা তৈরি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আমাদের ভাবতে হবে। এ গুমের পেছনে মহাজোটের কোনো স্বার্থ নেই। যেহেতু আমরা সরকারে আছি, তাই জবাবদিহি আমাদের প্রয়োজন, এটা সত্য। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ইলিয়াস আলীর ঘটনায় আমরা সকলে সমভাবে ব্যথিত, দুঃখিত। আমরা চাই, ইলিয়াস আলী ফিরে আসুক। কিন্তু এই গুম ঘটিয়েছে সেই চক্র, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় গুম-হত্যা চালিয়েছিল। এ চক্র দেশকে অস্থিতিশীল ও বিশ্ববাসীর কাছে অকার্যকর করতেই একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরও বলেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের হদিস আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটি সুপরিকল্পিতভাবে করা নিখুঁত হত্যাকাণ্ড। মধ্যপ্রাচ্যের এক কূটনীতিককে হত্যা করা হয়েছে, এটিরও রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এটিও একই চক্রের কাজ। আরেকটি কালো হাত এগিয়ে এসে দুই জোটের মধ্যে অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চাইছে।’
উনি আবিষ্কার করলেন ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীরাই ইলিয়াসকে গুম করেছে (দল বলছে বিএনপি নিজেরাই লুকিয়ে রেখেছে)। এরা দেশকে অস্থিতিশীল ও বিশ্ববাসীর কাছে অকার্যকর করতেই এসব করে চলেছে। আবার জামাত এবং সম্ভাব্য তৃতীয় শক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলে ফেললেন “আরেকটি কালো হাত এগিয়ে এসে দুই জোটের মধ্যে অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চাইছে।”
মাসখানেকেরও বেশি সময় প্রকাশ্য রাজনীতির বাইরে থেকে দলীয় রাজনীতির ক্ষুরধার (!) বৈশিষ্ট্যটা আবার ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। দেখা যাক, প্রধানমন্ত্রী তাকে কি বর দেন!
সুষ্ঠ তদন্ত দেখার অপেক্ষায় আছি, চাতকের মত (এই আমলে তো জানতে পারা কষ্টসাধ্য হবে তাই)।
আর সুরঞ্জিত বাবুর কাছে অনুরোধ, অনেক তো কামিয়েছেন (ধন ও মান), এবার অফ যান। বেহায়ার মতো হেসে ঘোলা পরিস্থিতিটা আরো ঘোলা করে দেবেন না। আইনকে আইনের পথে চলতে দিন। দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর পদটাও ত্যাগ করুন।
নির্দোষ হলে আপনাকে ফুলের মালা দিব আমি।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।