দেবী দূর্গা একজন শরীরসর্বস্ব নারী নন

ছবিঃ দ্যা ডেইলি স্টার

ছোটবেলায়, এমনকি এখনো দেখি, পূজার আগে মূর্তি বানানোর সময় কর্মকারেরা জায়গাটি বেড়া দিয়ে ঢেকে কাজ করেন “যতক্ষন না দেবীর গায়ে কাপড় পরানো হয়”।

এটা কেন করা হয় কারো সাধারন বুদ্ধি থাকলে বুঝার কথা।

কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটা বুঝেননা বা বুঝতে চান না আমাদের দেশের টিভির সাংবাদিক ও তাদের সাথে কর্মরত ক্যামেরাম্যানরা। তাদের বার্তা সম্পাদক/ইনপুট বসেরাও বিষয়টা খেয়াল করেননা, পুজার প্রস্তুতির খবরে দিয়ে দেন।

পেশাদার বা সৌখিন আলোকচিত্রীরা তো আরেক কাঠি সরেস। নান্দনিকতার কথা বলে তারা যেভাবে দিনকে দিন দেবীর “দেহে”র নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরে “সুন্দর ছবি”র প্রদর্শনী করছেন, তাতে আমি মর্মাহত।

গত কিছুদিন ধরে টিভি-পত্রিকা ও ফেসবুকে আমার চোখে পড়েছে এমন কিছু ছবি। আমি আশাহত। আমি অপমানিত।

আমার অনুরোধ থাকবে দেবীদের শরীর নয় বরং সেই দেবীকে পুজার পেছনে যে মাহাত্ম্য বা যে শক্তিকে পূজা করা হয় সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে ভিডিও করবেন বা ছবি তুলবেন আমাদের দেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষেরা।

লজ্জায় আমার মাথা হেঠ হয়ে আসলো হাসান বিপুল নামের এক তথাকথিত আলোকচিত্রীর ফেসবুক ওয়ালে এরকম একটা বাজে ছবি দেখে। এসবকে তারা হয়তো নান্দনিকতা বলবেন। কিন্তু আমি বলবো এসব নিছক পর্নোগ্রাফি/অন্যের ধর্মের উপর সরাসরি আঘাত। উনার উচিত ছিল হিন্দু ধর্মে মূর্তির মাহাত্ম্য/ গুরুত্ব কি সেটা আগে অনুধাবন করা।

উনি ছবির ক্যাপশন দিয়েছেন “creation of goddess” অথচ ছবিটি স্রেফ একটি আবক্ষ দূর্গা মূর্তি, যার মাথাটা আলাদা অবস্থায় তৈরি করে ঘাড়ে বসানো হচ্ছিল। তাছাড়া ক্যামেরার অবস্থান দেখে স্পষ্টই বুঝা গেল আলোকচিত্রীর টার্গেট ছিল দূর্গার “বুক”।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এটা কিভাবে সম্ভব!

প্রথমত, মূর্তি তৈরির সময়ে কর্মকারেরা চান না যে দেবীর নগ্ন মূর্তি কেউ দেখুক। এতে করে যে কারো বিশেষ অন্য ধর্মের মানুষদের (বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে) এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তারা হয়তো যৌনতা নিয়ে ভাবতে শুরু করতে পারে।

এবং আমি ছোটবেলাতে অনেক মুসলিমদের এধরনের কটুক্তি করতে শুনেছি। আমাকে অনেকেই বলেছে তোদের দূর্গা দেবী তো খুব সুন্দরী, তার শরীর অনেক আকর্ষনীয় ইত্যাদি।

এদের বেশিরভাগই কোনদিন ভাবেনা বা জানতেও চায়নি কেন দেবীকমূর্তিকে “অনন্যসুন্দর” করে তৈরি করা হয়। তারা জানেনা হিন্দুদের পারিবারিক/সমাজিক জীবনে যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা-আঘাত মোকাবেলা করতে দূর্গা দেবীর আরাধনা করা হয়। যেমন করে মুসলমানরা সাধারন বা বিশেষ নামাজের সময় খোদার সাহায্য কামনা করে।

এরা জানেনা দূর্গাকে “মা” বলা হয় কেননা তিনি তার ভক্তদের আরাধনার ফল দেন, দুষ্টের দমন করেন এবং শিষ্টের পালন করেন।

এই হাসান বিপুলের পোস্টে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম ক্যাপশনটা বদলে বরং লিখুন দেবীর নারীত্ব বা দেবীর দেহসৌন্দর্য-ধরনের কিছু। অথবা এমন কোন ছবি দিতে যার মাধ্যমে দেবীর শক্তি বা মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়।

উনি ও তার এক বন্ধু আমাকে নন্দনতত্ব বুঝালেন, শিল্প বুঝালেন, কিন্তু আমার অনুরোধ মানলেন না।

আমি অবশ্য এর পর “হিন্দু মৌলবাদীদের” মত কোন আচরন করিনি। তার বিরুদ্ধে ঘৃনা প্রকাশ করিনি। তাকে ব্লক করে দিয়েছি মাত্র। এরকম মানুষের সং আমার দরকার নাই।

আরেকজন আলোকচিত্রী সাহাদাত হোসেন, যিনি আমার ফেসবুক বন্ধু, তার প্রোফাইল ফটোতে দেবীর মুখ, অর্ধেক বুক, আর এক পাশের পাঁচটি হাত সমেত একটা নগ্ন ছবি দিয়ে রেখেছিলেন।

তাকেও অনুরোধ করেছিলাম এধরনের ছবি না দিয়ে শুধু দেবীর মুখশ্রীটাকে প্রাধান্য দিতে যেন দেখলে শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। যেনঙ্কারো চোখ দেবীর শরীরের দিকে আকর্ষিত না হয়।উনি আমার কথা রেখেছিলেন, তার ছবিটা পালটে ফেলেছিলেন।

আমি প্রায় আট বছর ধরে ছবি তুলছি। এখন পর্যন্ত এমন কোন ছবি কাউকে দেখাইনি বা ফেসবুকে দেইনি যা কার মনে আঘাত দিতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি বাস্তবে তেমন কিছু দেখিনি।

নন্দনতত্বই হোক বা সাম্প্রদায়িক ঘৃনাবোধ যে কারনেই এসব ছবি তোলা হোক না কেন, এগুলো জনসমক্ষে “হাইলাইট” করে দেখানোটা আমার চোখে অনৈতিক ও অন্যের ধর্মবিশ্বাসের উপর আঘাতের সামিল বলে আমি মনে করি।

Comments

  1. চাটিকিয়াং রুমান এভাটার

    আমাদের এদিকে শ্যামা পূজার কয়েকটা পোস্টারে দেবীদের নগ্নচিত্র দেখেছি। পোস্টারগুলোতে দেবীদের কেন নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা মাথায় আসেনি, কারণ পোস্টারগুলো স্থানীয় পূজা উদযাপন কমিটি কর্তৃক ছাপানো। তবে আমার মনে হয় পোস্টারে তাদের এভাবে উপস্থাপন করাটা অনুচিত।

    গত ৪ দিন আগে দেখা টালিগঞ্জের “কাহানি” মুভিতে দেখি দেবীদের নগ্নচিত্রের সামনে ছবি দৃশ্যায়ন করতে। যে কারো পক্ষে এ ধরনের কাজ করা মোটেও উচিত নয়।

    1. probirbidhan এভাটার

      ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। আপনার বাসা কোন এলাকায়?

      1. চাটিকিয়াং রুমান এভাটার

        আমার বাসা চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায়।

        1. probirbidhan এভাটার

          চট্টগ্রামের শহর এলাকায় নগ্ন ছবি দিয়ে পোস্টার! শুনে আমার মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। আপনি কি কষ্ট করে একটা ছবি তুলে আমাকে মেইল করতে পারেন? আমি এটা নিয়ে কিছু করতে চাই। আমার পরিচিত কয়েকজন সাংবাদিক আছেন চট্টগ্রামে। তাদের সাহায্য নেবো। ছবি তুলতে না পারলে অন্তত কারা আয়োজন করেছে বা পোস্টার ছেপেছে সেই সংবাদটা দিলেও হবে।

        2. probirbidhan এভাটার

          আর ভারতের সিনেমা ও শহুরে সমাজ ব্যবস্থা এখন আমেরিকার মত খিচুরি স্টাইলের। বাংলাদেশও একই পথে হাটছে।

      2. চাটিকিয়াং রুমান এভাটার

        আমাদের এলাকাটা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে পড়লেও এলাকাটা অনেকটা মফস্বলের মতো, শহরের মূল কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে। আর এলাকার যে অংশে পোস্টারটা দেখেছি সেটা মূলত হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যূষিত অংশ। আমি যদি পুনরায় ঐ দিকে যাই তাহলে অবশ্যই ছবি তুলে এবং তথ্য সংগ্রহ করে আপনাকে মেইল করবো।

        টালিগঞ্জের পথে যে বাংলাদেশও হাটছে তার সাথে একমত।

    1. probirbidhan এভাটার

      ধন্যবাদ ভাই। সময় পেলে পুজার মন্ডপ ঘুরে আসবেন আর প্রসাদ খেয়ে আসবেন।

      1. সাহাদাত উদরাজী এভাটার
        সাহাদাত উদরাজী

        আমরা পুরান ঢাকার শাখারী বাজারের পুজার মণ্ডপ ঘুরে দেখি প্রায় প্রতি বছরই।

        ভাল থাকুন।

  2. imran khan এভাটার
    imran khan

    ভাই দেবী দূর্গা যদি শরীর সর্বস্ব না হন
    তাহলে কি সর্বস্ব নারী একটু বলবেন?

    1. probirbidhan এভাটার

      উনি মানুষের মধ্যে থাকা সকল অশুভ শক্তির বিনাশকারী এবং পূন্যের দেবী।

  3. imran khan এভাটার
    imran khan

    উনি যখন মানুষের মাঝেই আছেন
    তাহলে তো উনি শরীর সর্বস্ব নারী
    ব্যাপার টী একটু বুঝিয়ে ব লেন তো?

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDবাংলা
Powered by TranslatePress