ব্রাজিলের নাইটক্লাবে আগুনে ২০০ জনের মৃত্যু, পদ্মা সেতু নিয়ে হাসিনার আশ্বাস, বিএনপিকে সংসদে না আসার জন্য দূষলেন রাষ্ট্রপতি, ফখরুলকে বিরক্ত করিও না ইত্যাদি হইলো ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, বিডিনিউজ২৪ডটকমের কয়েকটি বিশেষ সংবাদ যা বিশেষ গুরুত্বসহকারে শোভা পাচ্ছে তাদের ওয়েবসাইটে।
অথচ মোহাম্মদপুরের স্মার্ট গার্মেন্টসের সাত শ্রমিক নিহত হবার পর সেখানে যখন নানা অনিয়ম-দুর্নীতি-গাফিলতি ধরা পড়ছে সেখানে একটিও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখা যায়না। প্রথম আলো একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিলেও কয়েকঘন্টার মধ্যে সেই খবর “অন্যা্ন্য”-এর তালিকায় চলে গেছে।
এদিকে আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন তাজরীনের মালিককে গ্রেপ্তার করলে নাকি “সমস্যার সমাধান হবে না”! মালিকদের গাফিলতি ও অধিক মনাফালোভী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সরকার যেন একরকম সহমত জানালো।
তিনি এমন একটা সময়ে এই অযৌক্তিক কথাটি বললেন যখন দেখা গেল স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে “ময়নাতদন্ত ছাড়াই” লাশ আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। অথচ বলা হলো লাশ নাকি মর্গে পাঠানো হয়েছে। তার মানে সরকারিভাবে যেন প্রকাশ না পায় যে সাতজন নারী শ্রমিক আগুনে আটকে ছিলেন এবং পরবর্তীতে গেট খোলা পেয়ে বের হতে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে পদদলিত হয়েছিলেন। আর সে কারনেই শিকদার মেডিক্যালের ডাক্তার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মৃত্যুর কারন সম্পর্কে “ধোঁয়ায় আটকে থাকা, শ্বাসকষ্ট ও পদদলিত হওয়ার আলামতের” কথা বললেও সুরতহাল প্রতিবেদনে (ডেথ সার্টিফিকেট) লিখলেন হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে সবাই! কি অদ্ভুত! মানুষ যখন মারা যায় তখন তার হৃদপিন্ড বন্ধ হবেই, কিন্তু কি কারনে বন্ধ হলো সেটাই তো আসল কারন, তাই না? সরকারি হাসপাতালের বাইরেও সরকার যে শিকদার মেডিকেলের ডাক্তারকে সুবিধামত প্রতিবেদন করতে বলেছে তা আরো স্পষ্ট হয় এরকম হীন চক্রান্তে।
সাতটা মানুষ লাশ হয়ে গেলো তবুও রাষ্ট্রের অভিভাবক (জনগনের সেবক) সরকারতন্ত্রের প্রধান থেকে শুরু করে থানার সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত সবাই খামখেয়ালিপনার চুড়ান্ত নমুনা দেখাচ্ছে। আর তাতে আরো ফুঁসে উঠছে মানবতাবাদীরা যারা শ্রেনীবিভেদের কথা মাথায় রেখে মানুষের সাথে মেশে না বা কথা বলেনা, বা তার উপকারে এগিয়ে যায়না। আপাতত অনলাইন খবরের মন্তব্য অংশে, ফেসবুকে, ব্লগে লেখালেখি হচ্ছে সবাইকে এই মর্মস্পর্শী-নৃশংস ঘটনাটি ভালো করে জানাতে। সোমবার দুপুর ১২টায় তাজরীন গার্মেন্টসসহ এই ঘটনায় বিচারের দাবিতে এক নাগরিক সমাবেশ হবে কারওয়ানবাজারের বিজিএমইএ ভবনের সামনে।
Smart Export Garment Ltd, BGMEA, GOVT are you ‘smart’?
স্মার্ট গার্মেন্টেসের মালিক, কারখানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তা, রাজউকের পরিদর্শক দল, শিল্প মন্ত্রনালয়ের কারখানা পরিদর্শক দল, সিটি কর্পোরেশন — এমন আরো ভুরিভুরি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসকে পাওয়া যাবে যাদেরকে শনিবারের সাত শ্রমিক নিহতের ঘটনায় সরাসরি অভিযুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু কে ওদেরকে ধরবে? এদিকে বিজিএমইএ’র সদস্য নয়, মর্মে ঘোষনা দিয়ে তাদের দায়িত্ব এড়াতে চাইছে রপ্তানীকারকদের সংগঠনটি।
উচিত ছিল শনিবারেই পুলিশ সেই মামলাটি করবে,অথচ হয়নি রবিবারেও; এক নিহতের বাবা সে রাতেই একটি মামলা করলেও তার খবর যায়নি বেশিরভাগ মিডিয়াতে। কেমন যেন একটা লুকোচুরির খেলা চলছে। সবাই মিলে দিবালোকের মত সত্য একটা ঘটনাকে স্রেফ একটা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেন? কেন? কেন?
প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে এখানে সরাসরি পেস্ট করছিঃ
আগুন লাগার পর তা প্রতিরোধের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না মোহাম্মদপুরে গতকাল শনিবার পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানা স্মার্ট এক্সপোর্টের ভবনে। আজ রোববার সরেজমিনে কারখানাটি ঘুরে প্রথম আলো ডটকমের প্রতিবেদক এমন চিত্রই দেখতে পেয়েছেন। বিষয়টি স্বীকার করেছে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে আসা একটি তদন্ত দল।
দোতলা ভবনটির দ্বিতীয় তলাজুড়ে ছিল স্মার্ট এক্সপোর্টের কারখানা। আর নিচতলায় বিস্কুট ও রুটি তৈরির একটি কারখানা। পোশাক কারখানটিতে আগুন নেভানোর জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের কোনো সিলিন্ডার রাখা ছিল না। আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য বালুভর্তি টিনের একটি লাল রং করা বালতি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি।
আজ সকালে বেড়িবাঁধের পাশে এই পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে আসে ফায়ার সার্ভিসের একটি তদন্ত দল। পুরো কারখানা পরিদর্শন ও এর পোশাককর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন দলের সদস্যরা।
তদন্তকারী দলের প্রধান ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন) ভারত চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘অনেক কারণ থাকলেও নিশ্চিত হতে পারছি না, কীভাবে আগুনের সূত্রপাত। তবে এখানে আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না।’
কারখানাটির এক কর্মচারী মামুন রহমান বলেন, প্রথমে বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে আগুন ধরে। এখানে অনেক কার্টনে ভরা জ্যাকেট ছিল। এই জায়গাটার নিচে একতলায় আছে বিস্কুট কারখানার চুলা। ওখান থেকেও আগুন ধরতে পারে। মামুন আরও বলেন, ফোমের তৈরি জ্যাকেট থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তবে আগুন নেভানোর মতো কিছুই এই কারখানায় ছিল না।
স্মার্ট এক্সপোর্টের কাটিং মাস্টার কাওসার হোসেন প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, গত শুক্রবার পাঁচ হাজার পিস ফোম জ্যাকেট এখান থেকে শিপমেন্টের কথা ছিল। দুপুরের পর ছুটি হয়ে যাওয়ায় গতকাল সেগুলো পাঠানোর কথা জানানো হয়। কিন্তু আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
আজ সকালে পোশাক কারখানাটির শ্রমিক ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে স্মার্ট এক্সপোর্টের এই কারখানায় উত্পাদন শুরু হয়। গত বছরের জুন মাসের দিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একটি দল ভবনটি অবৈধ চিহ্নিত করে ভাঙতে যায়। একই সঙ্গে বিদ্যুত্সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কিন্তু আবার সব ঠিক করে দুই দিন পরই পোশাক উত্পাদন শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সন্ধানে আজ সকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত দলও ঘটনাস্থলে যায়। দলের প্রধান শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হাবিবুল ইসলাম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘সম্ভবত এই কারখানার কোনো অনুমোদন আমরা দিইনি। তবে কাগজপত্র দেখে বলতে পারব।’
বন্ধু কল্লোল মোস্তফার ফেসবুক স্ট্যাটাসঃ
তাজরিন গার্মেন্টস এর ঘটনার পর প্রথম কয়েক দিন কেবল ব্যাতিক্রম হয়েছিলো, নতুবা স্মার্ট গার্মেন্টস এর ঐ গেটটির শাটার ছুটির সময় ছাড়া বাকি সব সময় নামানোই থাকে বলে জানালো আগুন থেকে বেচে যাওয়া দুই বোন রহিমা আর ফাহিমা। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য: আগুন লাগার সময় অপেক্ষাকৃত বড় ঐ গেটটি যদি খোলা থাকতো তাহলে আরেক পাশের সংকীর্ণ সিড়ির গেটটি দিয়ে নামতে গিয়ে পদদলিত হয়ে বা সময় মতো নামতে না পেরে শ্বাসকষ্টে শ্রমিকরা মারা যেতো না।
৪/৫শ শ্রমিক কাজ করে এরকম একটি দোতলার সিড়ি কতটা প্রশস্থ হওয়া উচিত? স্মার্ট গার্মেন্টস এর সে সিড়িটি দিয়ে শ্রমিকরা নামতে বাধ্য হয় সে সিড়ি দিয়ে একসাথে দুজন লোক পাশাপাশি নামতে পারবে না। গার্মেন্টস এর একটাই ফ্লোর- সেটা দোতালায়। নীচ তলায় তিনটি রুটি-বিস্কিটের বেকারি। সিড়ির সামনেই টিনের ছাউনিতে একটি জেনারেটর। দোতালায় যে স্থানে শ্রমিকরা কাজ করেন সেখানেই পেছনের দিকে ঝুট কাপড়ের স্তুপ। সম্ভবত শর্ট সার্কিট থেকে সেই স্তুপে আগুণ লেগে দ্রুতই সারা কারখানা ফ্লোর ধোয়ায় ঢেকে যায়, সারা ফ্লোরে আগুণ ছড়িয়ে যায়। দোতালায় কোন অগ্নিনির্বাপন ব্যাবস্থার চিহ্নও চোখে পড়ে নি, শ্রমিকরাও কোন ফায়ার এলার্ম বেল শোনেননি। হঠাৎ করে আগুন আগুন চিৎকার শুনে সংকীর্ণ সিড়ির একটি মাত্র গেট দিয়ে এতজন শ্রমিকের পক্ষে সময় মতো সুস্থ অবস্থায় নামা অসম্ভব।
৪/৫শ মুরগী লালন পালন করার একটা খামারও যথেষ্ট পরিকল্পিত হয়। কিন্তু মুনাফাবাজ গার্মেন্টস মালিকের কাছে ৪/৫শ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী শ্রমিক ব্রয়লার মুরগীর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে এরকম নির্মম অবহেলায় মৃত্যুর আয়োজন করতে পারে তারা। তাজরিন গার্মেন্টস এর মালিকের যদি কঠোর শাস্তি হতো, যদি রাষ্ট্র বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত বাণিজ্যিক মুরগীর খামারের জৈব নিরাপত্তা রক্ষা করতে যতটুকু উদ্যোগি হয়- শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ততটুকুও উদ্যোগি হতো তাহলে হয়তো তাজরিনের ঘটনার পর পর কয়েকদিন দুটো গেটই খোলা রাখার যে চর্চা স্মার্ট গার্মেন্টস এ শুরু হয়েছিলো তা বজায় থাকতো, আগুণ লাগলেও স্মাট গার্মেন্টস এর এই শ্রমিকরা এভাবে মরতো না।
ফলে যে স্মার্ট গার্মেন্টস এর আগ্নিকান্ডে শ্রমিক হত্যায় রাষ্ট্র ও মালিক উভয়েই দায়ী, কার কাছে তার বিচার চাইবো? মালিকদের রাষ্ট্র কি মালিকদের বিচার করবে? তাজরিন কিংবা এর আগের কোন একটা ঘটনায় কি কোন মালিকের বিচার বা শাস্তি হয়েছে?…
রাষ্ট্রকে সকলে মিলে বাধ্য করতে না পারলে এবারও বিচার হবে না এবং বারবারই এরকম হত্যাকান্ড ঘটতেই থাকবে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।