ইউনূস সরকার পারফর্ম করতে পারছে না, পর্যবেক্ষণ সাংবাদিকদের

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকান্ড নিয়ে সবাই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। মূলত রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার কারনে এবং সংস্কার কমিশনগুলোতে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি না রাখায় সম্প্রতি সরকারের উপদেষ্টাদের সাথে বিভিন্ন দল এবং সাংবাদিকদের মতানৈক্য হচ্ছে। কিছু সাংবাদিক সম্প্রতি সরকারের অনিয়ম, দূুর্নীতি ও অদক্ষতা নিয়ে কথা বললেও সংখ্যায় তারা অনেক কম এবং এ ধরণের বক্তব্য তারা নিয়মিত দেন না। এছাড়া প্রায় সব পত্রিকা ও টিভি এখন বিটিভি হয়ে গেছে বলে মোটাদাগে বলা হচ্ছে।

এসব ইস্যুতে “তৃতীয় মাত্রা” টকশোর সঞ্চালক জিল্লুর রহমান এক ভিডিও মেসেজে বলেন, ৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশ নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু ৫ মাস না যেতেই আমাদেরকে এখন সরকারের ভুল নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। এই ভুলের পরিমাণ এক জায়গায় রেখে কেউ যদি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তাহলে বলতে হবে যে সরকার পারফর্ম করতে পারছে না, ফাংশন করতে পারছে না। কেন করছে না? সরকারপ্রধান প্রফেসর ইউনূস সম্প্রতি নিউ এজ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাতকারে বলছেন, তারা প্রস্তুত ছিলেন না, তাদের অভিজ্ঞতা নেই, তারও (অভিজ্ঞতা) নেই। রাজনীতিটা তারা বুঝেন না। কিন্তু আমরা জানি রাষ্ট্র পরিচালনা একটা রাজনৈতিক বিষয়।

“আরেকটা বড় ভুল তারা করেছেন যেটা তিনি বলেননি। যদিও তারা বলছেন যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ আছে, কথা বলছেন, শুনছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দলগুলোর সাথে তাদের কোন কৌশলগত সম্পর্ক নেই বা আস্থার সম্পর্ক তারা তৈরি করতে পারেননি। এটা ঠিক যে দলগুলো সবাই সরকারকে সমর্থন করছে। কিন্তু সরকারে থাকা কেউ কেউ কোন কোন অংশ এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করছেন যাতে করে সবাই তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তারা তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছেন এবং তাদের যে নিজস্ব একটা মনোবাসনা আছে, সেটা স্পষ্ট করে তুলছেন।”

অর্থনীতি ঠিক নেই, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভালো নেই, প্রশাসন কাজ করছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো এই সরকারকে কিভাবে নিচ্ছে বুঝা যাচ্ছে না। এরকম একটা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ আছে।

আমরা যদি অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি তাহলে এটা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট যে, দেশের জনগণ অতিষ্ঠ। অর্থনীতি কি এত খারাপ এই সরকারের আমলে হয়েছে? না, আগের সরকারের আমলে হয়েছে। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু এই সরকার ৫ মাসে কোনভাবেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে। কিন্তু ৫ তারিখ থেকে ৮ তারিখ বা ৫-৭ দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক কমে গিয়েছিল, অনেক নিয়ন্ত্রনের মধ্যে চলে এসেছিল। যে সময় প্র্যাকটিক্যালি দেশে কোন সরকারও ঠিকঠাকমতো ছিল না। তার মানে মানুষ ঐ সময় এতোটা স্বপ্নবাজ হয়ে উঠেছিল, এতো রক্তদানের পর মানুষের মধ্যে এমন একটা দেশপ্রেম বা অন্তর্নিহিত এমন একটা স্বপ্ন জেগে উঠেছিল যে, কেউ খারাপ কিছু করার কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু সরকার গঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে লাগলো। সেটা আসলে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের বুঝতে হবে।

অর্থনীতির হালচাল আপনি বুঝতে চাইলে এর জন্য বিশ্বব্যাংকের মতামত বা আইএমএফের প্রতিবেদন বা এডিবি কি বললো বা বাংলাদেশে আমাদের প্রতিষ্ঠান সিজিএস বা অর্থনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, বা সিপিডি বা পিআরআই কি বললো তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন, পথেঘাটে হাঁটাহাঁটি করেন, বাজারে যান বা গৃহিনীদের সাথে কথা বলেন যারা সনংসার সামলান, তাহলে আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন আসলে দেশের অর্থনীতির হালচাল কি। এটা বুঝার জন্য খুব বড় বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস তো অনেক দূরের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়ারও দরকার পড়ে না। সবাই বুঝতে পারেন যে, মানুষ ভালো নেই।

যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল অর্থনীতিকে গতিশীল করা। সরকার সেটা করতে পারেনি। কারও কারও পরামর্শে সরকার ২০০৭-০৮ সালের মতো পথে হেঁটেছে, মানে একটা প্যানিক তৈরি করা। যেই প্যানিকের ফলে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাচ্ছে না, ভয়ে ভয়ে আছে। হ্যাঁ, অনেক দুর্বৃত্ত না অলিগার মাফিয়া তৈরি হয়েছিল, আপনি তাদের বিচার করেন, কিন্তু একটা সিস্টেমের মধ্যে ফেলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যাদের হাতে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে, হাজার হাজার কর্মী যেকখানে কাজ করছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ট্রানজেকশন যারা করে, এদের সবাইকে আপনি জেলে পুররার চেষ্টা করবেন, দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিবে, এনবিআর তাদের উপর চড়াও হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একাউন্ট ফ্রিজ করে দেবে, তাদের আপনি বিদেশ যেতে দিবেন না। এমনকি অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানকে আপনি (সরকার) নানা অজুহাতে তাদেরকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করছেন। কারও বিদেশ থেকে টাকা আসবে, আপনি সেই টাকা নিবেন না, নিতে চাইবেন না। অথচ আপনার অর্থনীতি…আপনার টাকা নেই। কেউ ট্যাক্স দিতে যাবে, আপনি বলবেন উনার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে, উনার ট্যাক্স আগে নেয়া যাবে কিনা সেটা আগে চিন্তা করে দেখতে হবে। আরে ভাই ট্যাক্সটা নিয়ে নেন। অপরাধের জন্য যথাযথ বিচার করেন। টাকা দিলে কে না নেয়? আর সরকার কেন নিবে না? এসব করতে গিয়ে নানা ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য যে হচ্ছে, এসব তো আমরা খবর পাই। এই ৫ মাসে কি দুর্নীতি কি কমে এসেছে? বড় বড় দুর্নীতি হয়তো হচ্ছে না, কিন্তু পোস্টিং, নিয়োগ, বদল, প্রমোশনের জন্য বাণিজ্য তো হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দখল…যারা বড় বড় বিপ্লবী কথাবার্তা বলচছেন তাদের আমলনামাও তো আমি বিশ্বাস করি গোয়েন্দা সংস্থা ও সাংবাদিকদের অনেকের কাছে আছে।

কাজেই এসব বলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে কোন লাভ নেই। আপনাকে র‍্যাশনাল হতে হবে। আপনি চাইলেই সব করতে পারবেন না। বিদেশে টাকা পাচার যারা করেছে, আইনকানুন দিয়ে বা জোর করে বা আন্তর্জাতিক কোন শক্তির সাথে যোগাযোগ করে এই টাকা আপনি দ্রুত আনতে পারবেন না। এরকম কোন রেকর্ড নেই। এটি বহু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কতটা পারবেন সেটা নিয়েও সংশয় আছে। আমি মনে করি, এদেরকে যদি মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে এনে আলোচনার মাধ্যমে ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন প্রসেসের মধ্য দিয়ে যতোটা আনা যায়… এবং তারপরে আপনি অবশ্যই তাদের অপরাধের বিচার করতেন। সেটা অনেক ভালো হতো।

সেই কাজ না করে আপনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছেন, প্যানিক…সরকারকে স্ট্যাবল মনে হচ্ছে না, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্ট্যাবল নয়, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছে না। এমনকি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-আইএমএফ আপনার সাথে কাজ করতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। আর তারা এমন সব জিনিস চাপিয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে আইএমএফ। এটাই আইএমএফ। আপনি তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু তার চাপিয়ে দেয়া কাজ করতে গিয়ে আপনি নিজে যেভাবে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবার নানা পন্থা ছিল সেগুলো ব্যবহার না করে, আপনি ঐ এক প্রেসক্রিপশনে চলতে গিয়ে দেশের মানুষের উপর বোঝা বাড়িয়ে তুলছেন। আপনি শুধুমাত্র একটা প্রশাসনিক পদক্ষেপ দিয়ে এই কাজগুলো করতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেটা করে আসলে কিন্তু সম্ভব না। বরং অর্থনীতির চাকা যারা ঘুরান, সেই ব্যবসায়ীদের জন্য যদি পরিবেশ তৈরি করতেন, তাদের প্রণোদনা দেবার ব্যবস্থা করতেন, তাদেরকে আস্থায় নেয়ার চেষ্টা করতেন, তাদের মাথায় হাত বুলাতে চেষ্টা করতেন, তাদের দুষ্টুমি অপরাধটাকে আমলে নিয়ে সেটাকে সংশোধন করে বা বিচার করে…কিন্তু তাদের বাকি স্বাভাবিক কাজকর্মগুলো যদি করতে দিতেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলি যদি চলতে দিতেন, তাহলে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হতো, এই সংকটের মধ্যে আমরা পড়তাম না।

নিরাপত্তার সংকট আছে, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে না। চাঁদাবাজি চলে গেছে মনে করার কারন নেই। বরং কোথাও কোথাও অনেক বেড়েছেও, দখলবাজী আছে। কিন্তু এরর আবার একটা বড় প্রবণতা আমি দেখতে পাই যে, একটা বিশেষ দলকে আক্রমণ করে এই কাজগুলো হচ্ছে। যারা বিশেষ একটি দলকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন, তারা নিজেরাও কিন্তু অনেক কিছু দখল করে নিয়েছেন। তাদের অনেক প্রতিষ্ঠান বিগত সরকারের আমলে দখল হয়ে গিয়েছিল, জাতীয় পর্যায়ের। সেগুলোকে তারা দখল করে নিয়েছেন। গ্রামেগঞ্জে নানাজনের জায়গাজমি একজন দখল করে নিয়েছিল বিগত সরকারের আমলে, সেটাকে যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেউ আবার পুনরুদ্ধার করে সেটাকে আপনি দখলবাজী বলে ঐ দলটিকে বা শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে আপনি দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এই প্রোপাগান্ডা প্রচারণা কারা চালাচ্ছে। এসব হচ্ছে না যে এমন নয়। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে এই প্রচারণা, সেই বিএনপি কিন্তু তাদের হাজারখানেকের বেশি নেতাকর্মী বহিষ্কার করছে। কিন্তু আপনি এমন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করছেন, যে একটা শক্তিই করছে। অন্যরাও কিন্তু করছে। যে যেখানে পারছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও যে করছে না তা না। তাই এগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া দরকার।

নিরাপত্তার আরও অনেক ইস্যু আছে। আমরা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেক কথা বলি। আমি অবশ্যই বলবো ভারত বাংলাদেশের প্রতি অনেক অবিচার করেছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করেছে। সম্পর্কের টানাপড়েন আছে, আমরা ভালোমন্দের মধ্য দিয়ে গেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে সেখানে ভারত শক্তি জুগিয়েছে। কিংবা মানুষের মধ্যে ভারতের ব্যাপারে ক্ষোভ আছে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা জোর করে বা গায়ে পড়ে কারও সাথে ঝগড়া করতে চাই না। ভারত যদি ভুল বুঝতে পারে, কিংবা সে যদি ঠিকটঠাক বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, আমার তো কোন অসুবিধা নেই যদি আমরা একটা উইন-উইন সিচুয়েসশনের মধ্যে দিয়ে যাই। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমি সারাক্ষণ ঝগড়া লাগিয়ে রেখে আমার শক্তিক্ষয় করবো না, শক্তি সঞ্চয় করবো।

আমি ভারতের পক্ষে বলছি না। অনেকেই আবার বলতে চেষ্টা করছেন আমি এতোদিন আমেরিকার হয়ে কথা বলেছি, এখন ভারতের দালালি করছি। একটি প্রাণীর নামকে আমার নামের সাথে জুড়ে দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট আমি দেখেছি। কিন্তু আমি গর্বের সাথে বলতে পারি আমার দেশপ্রেমকে প্রশ্ন করার সুযোগ নাই; আমি অন্য কোন দেশের নয়, আমি বাংলাদেশের প্রো। আপনি ভারতের বিরোধীতা করেন, আমার অসুবিধা নাই। আমিও করতে চাই। ভারত যতগুলো অন্যায় করেছে, আমি প্রতিটা অন্যায় নিয়ে লিখেছি বা বলেছি। কিন্তু ভারতের বিরোধীতা করতে গিয়ে আমি কি অন্য কোন শক্তিকে সামনে আনছি? কেউ কেউ তো বলেই ফেলছেন আমার ওমুক দেশের (পাকিস্তানের) সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। আমি সবসময় বলি, আমার অর্থনৈতিক স্বার্থ যেখানে…যেমন আমার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো, ইউরোপের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো করতে হবে, কারন ওখানে আমার বাজার। ওখান থেকে আমি সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা পাই। আমার ছেলেমেয়েরা ওখানে পড়তে যায়। তাই আমার তার সাথে স্বার্থ অনেক বেশি। কিন্তু আপনি যদি শুধু ইডিওলোজির বিবেচনায় নিরাপত্তার ইস্যু বিবেচনা করে এই (ভারত-পাকিস্তান) লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে সেটা বিপজ্জনক। আমরা কিন্তু খেয়াল করছি না যে, আমাদের কিন্তু আরও কিছু শত্রু মিত্র আছে। আমার সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা বলি। আমার ভৌগলিক সীমার মধ্যে অন্য কোন শক্তি কি ঢুকে পড়ছে? আমার সীমানার মধ্যে কোন অংশ কি অন্য কেউ দখল করবার চেষ্টা করছে? যারা দায়িত্বে আছেন, নিরাপত্তা বাহিনীতে বা অন্যান্য জায়গায় তারা এই বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখবেন। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমরা একদিকে নজর দিতে গিয়ে অন্য জায়গাগুলো বা এক দরজা বন্ধ করতে গিয়ে আর বাকি ১০টা দরজা যেন খুলে না দেই, সেটা আমাদের মাথায় রাখা খুবই জরুরি।

আমি মনে করি অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সবগুলো জায়গায় আমাদের অনেক বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। সব কথার মূল কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান এখন রাজনৈতিকভাবে করতে হবে এবং সেটি একটি ভালো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে করতে হবে। সংস্কারগুলো করতে হবে, যেগুলোর ব্যাপারে ঐক্যমত আছে। সেখানে একটি জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি কোন রাজনৈতিক দল যদি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় তাদের পরিণতি শেখ হাসিনার মতো হবে বা তার চাইতে খারাপও হতে পারে। মানুষ তৈরি, তরুণরা জেগে উঠেছে – যেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু তরুণদের ব্যবহার করে কেউ যদি বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করবার চেষ্টা করেন, সেটাও বাংলাদেশের জনগণ, এই তরুণ সমাজ, এই ছাত্ররাই একসেপ্ট করবে না।

সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামালও ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিয়ে তার মতামত দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, সাক্ষাৎকারটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা বা সমালোচনা হয়নি। স্থানীয় মিডিয়ায় দেয়া ইউনূসের অন্যান্য সাক্ষাৎকারের চেয়ে নিউজ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীরেরটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। অনেক প্রশ্ন করেছেন যা হয়তো বিব্রতকর বা কঠিন। তার প্রশ্ন, এটিটিউড, বসার ভঙ্গিমা ছিল পেশাদারিত্বপূর্ণ। একজন সাংবাদিকের আচরণ এমনই হওয়া উচিত। তবে হয়তো কিছু ক্ষেত্রে আরও একটু কঠোর হতে পারতেন। এর আগে মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান ও হানিফ মোহাম্মদ নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা আমাদের লজ্জা দিয়েছেন। তারা হয়তো ভেবেছেন ইউনূস বিব্রত হতে পারে বা ভয় পেয়েছেন।

“অনেক প্রশ্নের উত্তরে ইউনূসের সারল্য বা সহজ ভঙ্গিতে জবাব দেয়ার বৈশিষ্ট্য এবার দেখা গেছে। তিনি বলেছেন, ‘এটা আমার নিজস্ব জগৎ নয়, এই জগতে আমি কোনদিন ছিলাম না, থাকার কোন আগ্রহও ছিলো না। এটার ডান বা বাম আমার জানা নেই। অনেকটা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলার অবস্থা। কাজেই ভিন্ন জগৎ। তাহলে কেন এলেন? ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ছাত্ররা তাকে প্রভাবিত করেছে, তারা বলেছে এই পরিস্থিতেতে আমার আসা দরকার। মানে অনেকটা অনুরোধে ঢেঁকি গেলা। ছাত্রদের অনুরোধে তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন কারন শিক্ষার্থীরা রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের ত্যাগের জন্য আমিও একটু ত্যাগ করলাম।’”

“কিন্তু ঢেঁকি তো গিলতে পারবেন না। ঢেঁকি তো গেলা যায় না। আপনি প্রাইভেট জেট কিনে আপনার অনভিজ্ঞ ছেলেকে চালাতে বললে সে কি করবে? ফলে প্লেনটা দুর্ঘটনায় পড়বে, ছেলেও মরবে, সপরিবারে আপনারাও মরবেন।

“এভাবে না জেনেও দায়িত্ব নেয়ার প্রবণতার ফলাফল কি? উনি না পারলে কি হবে? সেটা কি তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতার মধ্যে সীমিত থাকবে? না, পুরো দেশটা ডুববে। দেশের কান্ডারি যিনি হন, তিনি যদি অযোগ্য হন, সেই কাজের যোগ্য না হন, সেই কাজটা তিনি শুরু করলে পুরো দেশটাই মুখ থুবড়ে পড়বে। এখানে বিনয় ও ভদ্রতার জায়গা নেই। ইউনূস অসাধারণ ভালো মানুষ, অসাধারণ সৎ মানুষ। তাই বলে তিনি কি অসাধারণ যোগ্য মানুষ, অন্ততপক্ষে দেশ চালানোর ক্ষেত্রে? দেশ চালানোর যে যোগ্যতা আর ব্যাংক চালানোর যোগ্যতা কি এক?”

নুরুল কবির জিজ্ঞাসা করেছেন, এই সরকার এনজিও ও চট্টগ্রাম নির্ভর সরকার। কিন্তু ইউনূস কেন একশন নেন না? তিনি উত্তর দেন, “তারাও শিখবে। আমিও তো পারছি না। আমিও শিখছি।”

মাসুদ কামাল বলেন, “এইটা হইলো কিছু! এই যুক্তিটা দায়িত্বহীন ব্যক্তির উক্তি। উনাকে বুঝতে হবে, একটি জাতির সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে তাদের উপর। উনি তাদের দায় নিচ্ছেন। উনাকে বুঝতে হবে, উনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির দায়িত্ব নিয়ে আসেননি। উনার উচিত ছিল আরও যোগ্য লোক নেয়া যেন তাদের সাফল্য উনার ব্যক্তিগত অসাফল্যকে ঢেকে দিবে। অথচ উনি কি করলেন? নিজে তো পারেনই না, আরও যারা না পারে তাদেরকে নিয়ে আসলেন। এ নিয়ে যখন অনেকেই সমালোচনা করছে, কিন্তু উনি গুরুত্ব দিচ্ছে না। কাজ করতে করতে নাকি শিখবে। একজন নাগরিক হিসেবে আপনার এক্সপেরিমেন্ট করার মানসিকতা আমি গ্রহণ করতে পারব না। আমার জীবনের শংকা আছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নিয়ে আপনি খেলাধুলা করেন। এরকম দায়িত্বহীন কথা একটা দেশের সরকারপ্রধান কিভাবে বলে আমি বুঝি না।
আমি আগেই বলেচছি ইউনূস একজন ভালো মানুষ, উনি সৎ মানুষ। উনি সরলভাবে নিজের অদক্ষতা, অযোগ্যতাকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এই স্বীকারোক্তি আমাদের কি কাজে আসবে যদি এই জাতিকে ১৫ থেকে ২০ বছর পিছিয়ে দেয়? সারল্য যোগ্যতার কোন ভিত্তি হতে পারে না। যোগ্যতা দিয়েই সাফল্য পাওয়া যাবে, সারল্য দিয়ে নয়।
ইউনূস নিজেই স্বীকার করেছেন উনি নিজেও অযোগ্য, উপদেষ্টা পরিষদও অযোগ্য। হয়তো অনেকেই বলবে উনি বিনয় করে বলেছেন। এটা ভালো যে তিনি তা আত্মোপলব্ধি থেকে বলেছেন। তবে উনার বলা উচিত ছিল এদের আমি সরিয়ে দেব। সেটা না বলাটা আমি পছন্দ করি না।”

এই সাক্ষাৎকার নিয়ে তৃতীয় মাত্রায় কথা বলেছেন নুরুল কবীর নিজেও। “আমার যা জিজ্ঞেস করার ছিল, উনি সবগুলোর উত্তর দিয়েছেন। উনি নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে উনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। উনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান, এমন ধারণা আমার মধ্যে তৈরি হয়নি। সংশয় তো থাকেই। যদি ভুল হয় সেটা আমার বোকামি বলতে হবে ভবিষ্যতে।”

তিনি বলেন, “সরকারের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতায় থাকতে চায়। এর মধ্যে এক ধরণের ইঙ্গিত আছে। উনি বলেছেন, ‘কেউ বলতে পারে আমাদের নিজেদের মধ্যে, ৪-৫ বছর লাগবে।’ কে ক্ষমতায় থাকবে এটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কিছু বলবার নেই। কিন্তু এখন কে কি কাজ করছেন, ঠিকমতো করছেন কিনা, সেটা তো দেখবার ও মানুষকে বলার অধিকার আমাদের আছে।

“তিনি বলেছেন তার সরকারের পারফরম্যান্স নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। ফলে স্বাভাবিকভাবে জনগণ যারা ভুক্তভুগী তারা নিশ্চয়ই আগে নির্বাচন চাইবে। তিনি বলেছেন তারা হিমশিম খাচ্ছে। এরকম অবস্থায় কি কোন রাষ্ট্র চলতে পারে?

“রাষ্ট্রপ্রধানের সব বিষয়ে জানতে হবে এমন কথা নেই। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সে সমস্ত লোকদের একত্র করা রাষ্ট্র চালাতে যে ধরণের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বা দেখেছেন বা বুঝেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারকে তার রাজনৈতিক কাজ সেটাকে রাজনৈতিকভাবে দেখবার যে যোগ্যতা দরকার, সেরকম লোকদের তার চারপাশে একত্র করা। এনজিও, চট্টগ্রাম মানদন্ডে তার যাওয়া উচিত হয়নি। এই সরকার নিয়ে যে সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট হচ্ছে, সেটা হতো না। চারপাশে দক্ষ লোকজন থাকলে, রাজনৈতিকভাবে পরিপূর্ণভাবে দেখার সামর্থ্য থাকতো তাহলে এই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হতো না।

“সমস্যা সনাক্তের পর তার দ্বিতীয় দ্বায়িত্ব হলো সভাসদ বদলানো ও নতুন করে রিক্রুট করা। এটা না করার কারনে মানুষের দুর্ভাগ্য হবে। কারন এত আত্মত্যাগের পরেও কয়েকজন মানুষের অদক্ষতার কারনে এ দুর্ভাগ্য দেশের মানুষ মেনে নাও নিতে পারে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা প্রভাবশালী, যারা সঠিক তথ্য ছাড়া নিয়োগ পেয়েছেন, সরকারের বাইরে তাদের সাথে যারা যুক্ত, তারা দেশকে যেদিকে নিতে চাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে?
উনি স্বীকার করেছেন সরকারের নিজস্ব কোন সংস্কার কর্মসূচি নেই। প্রস্তাবনা পেলে রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ করবেন। তারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনার রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু তাতেই হিমশিম খাচ্ছে।

“তারা নাকি দিনরাত কাজ করছেন। কি কাজ করছেন বুঝতে পারছেন না। অথচ ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিলেই সমাজের চেহারা বদলে যেত। যেমন ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে পুরনো রিপোর্ট আছে, সেগুলো নিয়ে বসতে পারতেন। হাজার খানেক কমিউনিটি পুলিশ আছে যাদেরকে নিয়োগ দিতে পারতেন।

“ব্যাংকিং সেক্টর ঠিক হতে দেরী হতে পারে, কোষাগার শূণ্য করে লুটপাট হলে… কিন্তু রাস্তায় গাড়ি চলার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগ হলে, মনিটরিং করার জন্য দক্ষ ও আন্তরিক লোক থাকলে হতো।

“এই সরকার যদি নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু তাদের ক্ষতি হবে না, প্রত্যেকের ক্ষতি হবে। আশাহত হবে শহিদ, আহত ও সমাজের সবাই। এজন্য যে ধীশক্তি দরকার, যে কমিটমেন্ট সরকার, এটা আমরা দেখি না।
এসব সমালোচকদের উপর তারা ক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ্যে বলেন না। তারা নিজেরা নিজেরা সমালোচকদের পিন্ডি চটকান।

সরকারের কেউ কেউ বা ভেতরে বাইরে থাকা প্রভাবশালী একটা অংশ, একটি রাজনৈতিক বলয়কে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে, দেশকে অন্য ভাবধারায় নেয়ার চেষ্টা করছে, এ প্রসঙ্গে নুরুল কবীর বলেন, “তরুনদের রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্টতাকে ও উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক শূণ্যতা তৈরি হয়েছে। তাই তরুনরা যদি রাজনৈতিক ধারা হিসেবে তৈরি হয়, আমি সেটাকে স্বাগত জানাবো। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের বিভিন্ন বক্তব্য বিভিন্ন রকমের। তাদের অতীত সুসমন্বিত নয়, বিভিন্ন দল/জায়গা থেকে এসেছে। তাদের রাজনীতি কি হবে, কি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সেই রাজনীতি করবে, সেটা পরিষ্কার না। তাদের যা চিন্তা করা উচিত, আরেকজনের নীতিবোধ বা কান্ডজ্ঞান দিয়ে তারা পরিচালিত হবেন সেই দাবী আমি করি না। ইতিহাসের কাছে শিক্ষা আছে। তারা তো ইতিহাস বদলাতে চান বা নতুন ধারা তৈরি করতে চান, কিন্তু ধারাটা কি হবে, তাদের রাজনৈতিক কৌশল এসব বিষয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

“সমাজে গুঞ্জন আছে বড় টাকার মালিকদের কাছ থেকে তারা চাঁদা নিচ্ছে। নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি লাঞ্চ। সেটা তাদের জন্য একটা বিনিয়োগ বা অতীতের দায় থেকে মুক্তির জন্য এক ধরণের উৎকোচ। এটা যদি চলতে থাকে, তাদের ইমেজ এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তাদের আচরণের পার্থক্য যদি তিরোহিত হয় তাহলে এই ধারা বেশিদূর এগুবে না। আমি দেখিনি, কিন্তু অভিযোগ শুনেছি। অভিযোগের সত্যতার কিছু সিম্পটম আছে। তাদের জীবনযাপন, যানবাহন, এর উৎস, বড় ভাই। যারা এসব কিনে তারা (ভালোবেসে) দিয়ে দিতে পারে, এখানে একটা বৈষয়িক স্বার্থের সম্পর্ক তৈরি হতে বাধ্য।

“এই আন্দোলনের নাম ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এই কথায় কনভিন্সড হয়ে হাজার হাজার নারী পুরুষ শিশু, মধ্যবিত্ত গরীব মানুষ নেমেচছিল, তারা আবার প্রতারিত হতে বাধ্য হবে, যদি তাদেরকে বিত্তবানদের পয়সায় সংগঠন চালাতে হয়। আমার পরামর্শ থাকবে তাদেরকে গণতান্ত্রিক চিন্তা নিয়ে একটা রাজনৈতিক ধারা স্ষ্টি হলে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে একটি ইতিবাচক ফল আনতে পারে। কিন্তু দল পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক স্বচ্ছতা দরকারি।”

Comments

“ইউনূস সরকার পারফর্ম করতে পারছে না, পর্যবেক্ষণ সাংবাদিকদের” এ একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

bn_BDবাংলা
Powered by TranslatePress