সরকারের দুই উপদেষ্টাসহ এবং জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক নেতা, কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও লেখকদের আয়োজনে ২৬শে জানুয়ারি কুড়িগ্রামে জেলে, তাঁতী ও কৃষকদের মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছে, যা আদতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচনী প্রচারণা বলেই মনে হচ্ছে।
আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ হাসান নলেজসহ অনেক আলোচক বর্তমান সরকারের অংশ হওয়া স্বত্বেও তারা সরকারের কাছে জেলে, তাঁতী ও কৃষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১২টি দাবি উত্থাপন করছেন। নলেজ অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের আমলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে নিয়োগ পান।

এই আয়োজনের যৌক্তিকতা, উদ্দেশ্য ও সরকারি কোষাগারের অর্থব্যয়ের পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট নিয়ে সমালোচনা ও হাস্যরসের সৃষ্টি হলে উপদেষ্টাদের ২৫-২৬ জানুয়ারির সফর স্থগিত করে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে ২৩শে জানুয়ারি।
এর আগে দুই উপদেষ্টার সফর নিশ্চিত করে ২০শে জানুয়ারি জেলা প্রশাসক বরাবর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।
মহাসমাবেশের খরচ বাবদ ৬৫ লাখ টাকা চেয়ে নলেজ গত ২১শে জানুয়ারি সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, বাজেট তৈরিতে সরকারের লোকজন নির্দেশনা দিয়েছেন। অবশ্য তিনি আয়োজকদের সবার নাম এখনও প্রকাশ করেননি। সরকারের কাছ থেকে অনুদান চাওয়াকে তিনি নাগরিক ও সংগঠক হিসেবে ঠিক আছে বলে দাবি করেছেন।

তিনি বলেন, উপদেষ্টারা না আসলেও কর্মসূচি স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি। এমনকি সরকারের চেয়েও টাকা না পাওয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না নলেজ। বৃহস্পতিবারও চিলমারীতে এই কর্মসূচি ঘিরে আয়োজকদের প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।
সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা একটি পোস্টারে দেখা গেছে, একপাশে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও অন্য পাশে শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হকের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটির আহ্বায়ক নলেজ পেশায় চিলমারীর শাখাহাতি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তার বাড়ি উপজেলার রমনা সরকারবাড়ী গ্রামে। তবে তিনি কুড়িগ্রাম শহরের কলেজপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।
কুড়িগ্রামের একজন সংগঠক, যিনি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন সমস্যা, কৃষি রক্ষা, কৃষকের অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এবং জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখেন। একসময় রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন কমিটি নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করতেন।

এই মহাসমাবেশে উদ্বোধক হিসেবে নাম আছেন মৎস্য ও প্রাণী উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের, যিনি কৃষি গবেষণা ও ব্যবসার সাথে জড়িত। এছাড়া তার জীবনসঙ্গী হিসেবে পরিচিত লেখক ফরহাদ মজহার জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ও ছাত্র উপদেষ্টাদের সরাসরি দীক্ষাগুরু বলে জানা যায়।
প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা হয় দুর্যোগ ও ত্রাণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমকে। আলোচক বা অতিথিদের মধ্যে কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাউকে রাখা হয়নি।
অন্যদিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই মহাসমাবেশের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও এবং উপদেষ্টা আজমের সাথে জেলে, তাঁতী বা কৃষকদের দূরতম সম্পর্ক না থাকলেও উপদেষ্টাকে রাখার কারন হলো টাকার জোগান। হ্যাঁ, এই প্রমোশনাল ইভেন্টের জন্য ধরা ৬৫ লাখ টাকার একটি বাজেট অনুমোদনের জন্য কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
কোথায়, কেন এত খরচ?
সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে নলেজ লিখেছেন, “বিনীত নিবেদন এই যে, কৃষক-জেলে-তাঁতীরা যুগ-যুগান্তের বঞ্চিত ও ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। তাদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আগামী ২৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে উপস্থিত থাকবেন রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের সব জেলার কৃষকরা। আশা রাখি, লক্ষাধিক কৃষক এতে উপস্থিত হবেন। আমরা তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার কৃষককে এক বেলা আহার করাতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম (বীরপ্রতীক)।”

এর নিচে একটি ছক করে বরাদ্দের ধরন ও খরচের হিসাব দিয়েছেন নলেজ। সে অনুযায়ী, ৩০ হাজার অংশগ্রহণকারী জেলে, তাঁতী ও কৃষকের খাবারের জন্য ২০০ টাকা হারে ৬০ লাখ, ভিআইপি ১০০ জনের খাবারের জন্য ৫০০ টাকা হারে ৫০,০০০ এবং স্টেজ, সাউন্ড সিস্টেম, গেট, লাইটিং, বসার ব্যবস্থা, তোরণ এবং আনুষাঙ্কিত অন্যান্য ৫ লাখ টাকার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।
আয়োজকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই প্রথম কৃষকরা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে মহাসমাবেশে সামিল হচ্ছেন। এতে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ উত্তরবঙ্গের সবগুলো জেলা থেকে কৃষকরা আসছেন। ইতিমধ্যে শত শত নৌকা প্রস্তুত হচ্ছে। চরাঞ্চলগুলোতে ব্যাপক প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন কুড়িগ্রাম জেলার হাটগুলোতে সভা হচ্ছে। লিফলেট বিতরণ হচ্ছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পোস্টার ও দেয়াল লিখন।
ঐতিহাসিক জোড়গাছ হাট সংলগ্ন ভাওয়াইয়া শিল্পী সফিউল আলম রাজা স্টেডিয়ামে প্রস্তুতির কাজ চলছে। উলিপুর ভাওয়াইয়া একাডেমিতে চলছে সাংস্কৃতিক পর্বের মহড়া। এর বাইরে গাইবান্ধার সাঁওতাল শিল্পীরা, ঢাকা থেকে আসবেন অভিনেত্রী নওশাবা আহমেদ ও অভিনেতা দীপক সুমনের তীরন্দাজ নাট্য দল অংশ নেবেন।
এই মহাসমাবেশের খরচ বহন করতে গিয়ে আয়োজকরা ব্যাংক একাউন্ট ও মোবাইলে গণচাঁদাও সংগ্রহ করছে।
নলেজ বলেন, “আমরা ডিম-খিচুরি খাওয়াইতে চাইছিলাম। কিন্তু সরকারের লোকজনই বলেছে যে, ৬০ টাকা হবে কেন? আপনারা মুরগি দিয়ে খাওয়ান। এতে কৃষকপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।”
রাজনৈতিক শোডাউন?
উক্ত মহাসমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ আলোচক হিসেবে থাকবেন ইউনূস সরকারের কিংস পার্টি জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, যারা আগামী মাসে রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে তারা বিভিন্ন খাতভিত্তিক কেন্দ্রীয় সেল এবং দুই শতাধিক উপজেলা কমিটি করেছেন।

সরকার ও জুলাই অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট অন্যদের মধ্যে আরও আছেন ৫ই আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মোর্শেদ, বামপন্থী নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবি আব্দুল হাই শিকদার।
প্রধান আলোচক হিসেবে আছেন সরকারের অন্যতম শরীক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম। এছাড়া এই সংগঠনের সভাপতি আহমেদ ইসহাকসহ আরও দুই কেন্দ্রীয় নেতা কনক রহমান ও রাখাল রাহার উপস্থিতির কারনে এটি অনুমেয় যে, এরাই মূল আয়োজক।
এছাড়া তাদের সমমনা বাংলাদেশ ভূমিহীন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নাছির উদ্দিন, পরিবেশ ও কৃষি গবেষক পাভেল পার্থ এবং প্রাকৃতিক কৃষি গবেষক ও সাংবাদিক দেলোয়ার জাহানের নাম আয়োজকদের প্রচারপত্রে রয়েছে।
কি কি দাবী তুলছে আয়োজকরা?
উত্তরবঙ্গ কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটির দাবীগুলো খুবই যৌক্তিক, প্রগতিশীল ও মানবিক।
যেমন, হাট ও ঘাটে জমিদারী আমলের ইজারাপ্রথা বাতিল, ভাঙনরোধে নদীর পাড় ও চর এলাকায় বিন্না ঘাস লাগানো,, চরাঞ্চলে ভুয়া ভূমিহীনদের হাত থেকে খাসজমি দখলমুক্ত করা, বন-নদীনালা-বিল-পাহাড় দখল-বিক্রি ও ইজারা দেয়া বন্ধ করা, ইলিশ ছাড়াও সকল মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, খাসজমিকে এজমালি গোচারণভূমি ও প্রাকৃতিক বন হিসেবে ঘোষণা করা, কৃষককে গুড় উৎপাদনের স্বাধীনতা দেয়া, রেশম ও এন্ডিপোকার লার্ভা খোলা বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা, কৃষকের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে লবনসহ কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ, আন্তঃনগর ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য বগি সংযুক্ত করা, কৃষিকে কর্পোরেশনগুলোর হাত থেকে রক্ষা করা, অনাদায়ীসহ সকল ধরণের ক্ষুদ্র কৃষিঋণ মওকুফ, গোবিন্দগঞ্জ ও ফুলবাড়ির কৃষকদের মিথ্যা মামলা বাতিল করা ইত্যাদি।
এই মহাসমাবেশকে ঘিরে প্রচারণার জন্য বেশকিছু পোস্টার ডিজাইন করে দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সংস্কৃতি সেলের সদস্য ও প্রবাসী শিল্পী দেবাশীষ চক্রবর্তী।

রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে দেখা যায় ১০০-১৫০ মানুষের জমায়েত আর অসংখ্য খালি চেয়ার। আর মঞ্চে উপবিষ্ট বক্তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল হাসনাত কাইয়ুমসহ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অন্যান্য নেতারা।
তারা অভিযোগ করেন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের এই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ পন্ড করা হলেও তারা দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।