লাল টেপে মোড়ানো বলের মত জিনিসটা পেয়ে পিচ্চিটা মজা পেলো, ছুঁড়ে মারলো তার খেলার সাথীর দিকে। কিন্তু বিধিবাম! একটা বিকট আওয়াজ-ধোঁয়া, হাত দুইটা মনে হয় ছিঁড়ে পড়ে গেলো। অনেক রক্ত! আশেপাশে সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো, দু’একজন এগিয়ে এলো, পিচ্চিটাকে কোলে তুলে নিয়ে পানির খোঁজে দৌড়ালো কেউ একজন, হাতদুটো ধুতে গিয়ে চোখে পড়লো আঙ্গুল আর খুবলে খাওয়া তালু, মুখে আর বুকেও লেগেছে স্প্লিন্টার।
এমন ঘটনা আজকাল হরহামেশাই ঘটছে, মানে দেশের অবস্থা একটু(!) খারাপ। সরকারবিরোধীরা আন্দোলন চাঙ্গা করতেই ককটেল আর হাতবোমা বানানো শুরু করে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগের বছরটাতে। এবার অবশ্য আরেকটা ইস্যু আছে – যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল আন্দোলন।
এর মধ্যে আরো দুইটা সংশ্লিষ্ট বিষয় এসে যোগ দিয়েছে – সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে শাহবাগের গনজাগরনমঞ্চ আর তার সাথে যুক্তদের(!) ইসলাম ও মহানবীকে কথিত অবমাননা নিয়ে আমারদেশ-ইনকিলাব-সংগ্রামের ক্যাম্পেইন।
ফ্রন্টলাইনে রাখা হয়েছে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের, সাথে আছে কুশিক্ষিত মুসলমানরা; আর পেছনে আছে বিএনপিসহ সকল বিরোধীদল।
মাঠের অপরদিকে আছে সরকার।
শাহবাগ এদের কারো সাথেই নয়, ছিলও না। মঞ্চের কয়েকজন সরকারীদল সমর্থক ও নেতা হলেও তারাই সব না। আর যারা শুধুমাত্র একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছিলেন তারাও সরকার সমর্থক নন।
কিন্তু কুচক্রীদের ক্রমাগত প্রোপাগান্ডায় আর সরকারের দুর্বল তদন্ত ও অকার্যকর মিডিয়া যোগাযোগের কারনে এবং কয়েকজন সরকারপন্থীর অতিউৎসাহী কার্যক্রমের কারনে জনমনে ধারনা হয়েছে শাহবাগ সরকারের দ্বারা পরিচালিত ও লালিত-পালিত একটি আন্দোলনমঞ্চ। আর এই ধারনা তৈরি করার কারনটা হলো শাহবাগকে সরকারের কোর্টে ফেলে একই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা।
কিন্তু এমতাবস্থায়ও সরকার ধীরে চলো নীতিতে এগুচ্ছে; আর অপরপক্ষ ক্রমশ দলভারী করে আক্রমনের মাত্রা বাড়াচ্ছে; পরিকল্পনা করছে ৬ই এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে শহর দখল করার। কে জানে হয়তো তারা আক্রমন চালাবে মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের উপর, জেলখানা-ট্রাইব্যুনালের উপর, শাহবাগের মোড়ে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করবে – সারাদেশে ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে যে ধরনের ভয়াবহতা দেখছি আমরা, তারই একটা রূপ হয়তো দেখা যাবে ঢাকাতেই; টিভি লাগবেনা, রাস্তা বা ছাদ থেকেই দেখা যাবে। কেউ কেউ হয়তো দেখবেন একাত্তরের ডিসেম্বরের মত কারো কারো বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে যাবে বা হামলা করবে সদস্যদের উপর, লুট করে আগুন জ্বলে দিয়ে যাবে; হিন্দু হলে ধর্ষন করবে মা-বোনদের, শিশুরাও বাদ যাবেনা, মূর্তি-টুর্তি থাকলে মাথা কেটে ফেলা হবে।
এমতাবস্থায় ইতিমধ্যেই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়াটা একটি গনতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে দাবী করা আওয়ামীলীগ ও সরকারে থাকা অন্যনায় দলের উচিত ছিল।
আর শাহবাগে উচিত ছিল সরকারকে দিনের পর দিন সময় না দিয়ে শুরু থেকেই চেপে ধরা। বিয়াল্লিশ বছরের আবর্জনা সরাতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু শুরুটা করতেই যদি এত দেরী হয়, তাহলে নিরস্ত্র-শান্তিপ্রিয় জনগন কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে? সাংবিধানিক সরকারই যদি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমত পুতুলখেলা চালিয়ে যায়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের কর্মচারী পুলিশ আর স্বাধীনতাকামী-মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির জনগনের ভয় কাটাবে কে? যুদ্ধাপরাধী-উগ্র মুসলিমদের সংগঠন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে পথে-অনলাইনে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাত্র-যুবসমাজের দিকে সরকারের সাড়াঁশি আক্রমন আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছুই না।
হাতে গোনা কয়েকজনের কৃতকর্মের জন্য সমস্ত ব্লগ ও ফেসবুকের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, মাঝরাতে ব্লগারদের ধরে গোয়ান্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া, সাতদিনের রিমান্ডে নেবার আগে মাননীয় সরকার, আপনার আরো কিছু কাজ ছিল। সব ধর্মবিরোধীদের বিরুদ্ধে আপনারা ব্যবস্থা নিবেন, নেন। কিন্তু তারা কারা? এইসব ব্লগাররা, নাকি একাত্তরের ঘাতক-উগ্র মুসলিম-সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবির?
সরকার নাকি কুরুচিপূর্ণ ব্লগ ছাপানো ও সন্ত্রাস উস্কে দেবার জন্য জন্য পত্রিকার [আমার দেশ, সংগ্রাম, ইনকিলাব] বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে, সেজন্যে নাকি ঢাকা জেলা প্রশাসককে [আওয়ামীলীগ নেত্রী হাসিনা দৌলা] চিঠি দেয়া হয়েছে… আবার সারাদেশে চলমান হামলা-ভাংচুরের জন্য বিরোধীদলীয় নেতাদের হুকুমের আসামী করা হবে… এইগুলা ছিল দুই(তিন) মন্ত্রীর মঙ্গলবারের প্রেস কনফারেন্সের ‘সাইডটকস’… আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারির দাবী জামায়াতকে নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া নাকি শীঘ্রই শুরু(!) হবে!!!
দেশ ও দলকে ডুবাতে যথার্থ পথেই আছে আওয়ামীলীগের মহাজোট সরকার, যেই সরকারের ফ্যাক্টর স্বৈরাচার এরশাদও শাহবাগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ইসলামের শত্রু আর নাস্তিক বলতে দ্বিধা করেনা।
আমাদের চারপাশে এখন শকুনেরা ঘোরাঘুরি করছে, সরকার আছে কি নেই বুঝতে পারছিনা, কারন তাদের কোন শক্ত অবস্থান দেখা যাচ্ছেনা, শুধু মুখে কড়াকড়া বুলি আওড়াচ্ছেন উনারা।
এবার আর কারো জন্য অপেক্ষা নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিজেদেরকেই হাল ধরতে হবে নিজেদেরকে রক্ষা করতে। যাদের ঘৃনা করি, তাদের ঘৃনা করবোই, কারন আমি ইতিহাস জানি, আমি অনুভব করি শহীদের আত্মত্যাগ, লক্ষ মা-বোনের ধর্ষন-নির্যাতনের ভয়াবহতা, ঘরবাড়ি হারানো সাধারন নিরস্ত্র মানুষের হাহাকার, ভারতের শরনার্থী শিবিরে কোটি মানুষের মানবেতর জীবন… আমি এসব জানোয়ারদের ক্ষমা করবো না, এক মুহুর্তের জন্যেও না, কোন সুবিধার বিনিময়েই না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আত্মসমর্পন দলিলে সাক্ষর করলেও পাকিস্তান বা তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামী তথা শান্তি কমিটি, ইসলামী ছাত্র সংঘ, আলবদর, আলশামসরা কিন্তু এখনও মেনে নেয়নি এই বাংলাদেশকে; তদুপরি গনহত্যা-ধর্ষন-লুট আর অগ্নিসংযোগের জন্য এদের কেউই এখনো ক্ষমা চায়নি জনগনের কাছে। কিন্তু এখনো, এই ৪২ বছর পরের ২০১৩ সালেও এরা প্রভাব বিস্তার করে আছে রাজনীতি-মসজিদ-মাদ্রাসা-ব্যবসাক্ষেত্রে।
এই মুহুর্তে এদের নিষিদ্ধ করুন, প্রয়োজনমত শক্তি প্রয়োগ করুন; সংবিধান সরকারকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। জনগনও তৈরি, কিন্তু শুরুটা করতে হবে এই সরকারকেই। দেরী করার সময়টাও চলে গেছে অনেক আগেই। আর কতো খামখেয়ালীপনা দেখাবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? এই কি আপনার আত্মত্যাগের নমুনা!!!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.