আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ভায়রা সৈয়দ মোঃ কায়সার একজন ব্যবসায়ি। তার জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯শে জুন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা (নোয়াপাড়া) গ্রামে। পড়াশুনা ঢাকার আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৬২ সালে সে ফজলুল কাদের চৌধুরীর কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগ দেয় এবং ১৯৬৬ সালে সিলেট জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। ১৯৭০–এ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মনবাড়িয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানবিরোধীদের নির্মূল করতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সাথে একযোগে গনহত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নসংযোগ ও লুটপাট করে। পাশাপাশি ৫০০–৬০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি দল গঠন করে যারা “কায়সার বাহিনী” নামে পরিচিত ছিল। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের রায়ে এই দলকে নেকড়ের দলের সাথে তুলনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে তার সাধের পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে কায়সার লন্ডনে পালিয়ে যায় এবং ১৯৭৮ সালে রাজাকারদের আশ্রয়দাতা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফিরে আসে। ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সিলেট–১৭ আসন থেকে বিজয়ী হয় এবং কিছুদিন পর বিএনপিতে যোগ দিয়ে হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পায়।
জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হয়।
এরপর কায়সার জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে হবগঞ্জ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে হবিগঞ্জ–৪ আসন (মাধবপুর–চুনারুঘাট) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় এবং একবার কৃষি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
কিন্তু ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়। সর্বশেষ ওয়ান–ইলেভেন সরকারের সময় সে পিডিপি–তে যোগ দেয়।
২০১৩ সালের ১৫ই মে তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী করার আবেদন করে এবং ২১শে মে তাকে গ্রেপ্তার করে পরদিন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তখন থেকে সে কারাগারে আটক আছে। এর মধ্য দিয়ে কায়সারের ৪১ বছরের মুক্ত জীবনের অবসান হয়।
তবে একই বছরের ৫ই আগস্ট কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়া হয় এবং ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষনার আগ পর্যন্ত সে তার বনানীর বাসায় অবস্থান করে।
২০১৩ সালের ১০ই নভেম্বর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল হয় এবং পরের বছর ৩০শে জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলা চলাকালীন প্রসিকিউশন ৩২জন সাক্ষীকে হাজির করে, কিন্তু কায়সার কোন সাক্ষী যোগাড় করতে পারেনি। এমনকি তাজুল ইসলাম নামে কায়সার বাহিনীর একজন সদস্যও আদালতে কুখ্যাত এই বাহিনীর কর্মকান্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
বিচারের শেষ পর্যায়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২০শে আগস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখেন এবং কায়সারের জামিন বাতিল করে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
বিচার চলাকালীন কায়সারের আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভুল প্রমানে ব্যর্থ হয়, এমনকি তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে কায়সার বাহিনীর কর্মকান্ডকে অস্বীকারও করেনি।
কায়সারের বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আদালত সাতটিতে মৃত্যুদন্ড, একটিতে আমৃত্যু কারাদন্ড, তিনটিতে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, দুইটিতে মোট ১৭ বছরের কারাদন্ডাদেশ দেন। তিনটি অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় আদালত তাকে খালাস প্রদান করেন।
১) ১৯৭১ সালের ২৭শে এপ্রিল ব্রাহ্মনবাড়িয়ার ইসলামপুরে একজনকে হত্যা, অপর একজনকে নির্যাতন এবং ১৫টি বাড়িঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ – আমৃত্যু কারাদন্ড
২) ২৭শে এপ্রিল মাধবপুর বাজার ও পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারা গ্রামের ১৫০টি বাড়িঘর ও দোকানে লুট ও অগ্নিসংযোগ – ১০ বছরের জেল
৩) ২৭শে এপ্রিল মাধবপুরের কৃষ্ণনগর গ্রামে চারজনকে হত্যা, এবং ৪০–৪৫টি বাড়িতে লুট ও অগ্নিসংযোগ – মৃত্যুদন্ড
৪) ২৮শে এপ্রিল মাধবপুর বাজারে ১৫জনকে হত্যা এবং ১৫০–২০০টি বাড়িঘর ও দোকানে লুট ও অগ্নিসংযোগ – খালাস
৫) ২৯শে এপ্রিল শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্য গুদামে সাতজনকে নির্যাতন, একমাস বন্দী রেখে ২৯শে মে তাদের হত্যা করা – মৃত্যুদন্ড
৬) ২৯শে এপ্রিল শায়েস্তাগঞ্জে দুইজনকে নির্যাতন, গাছে ঝুলিয়ে ও গুলি করে হত্যা – মৃত্যুদন্ড
৭) ৩০শে এপ্রিল হবিগঞ্জ শহরে ৪০–৪৫টি বাড়িঘরে লুট ও অগ্নিসংযোগ – সাত বছরের জেল
৮) ১১ই মে চুনারুঘাটের চানপুর চা বাগানে হীরামনি সাঁওতালকে ধর্ষণ – মৃত্যুদন্ড
৯) ১৫ই মে মাধবপুরের লোহাইদ গ্রামে আটজনকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা – যাবজ্জীবন কারাদন্ড
১০) শায়েস্তাগঞ্জ ডাক বাংলোতে একজনকে হত্যা ও অন্য একজনকে নির্যাতন – মৃত্যুদন্ড
১১) ২৩শে জুন ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকার হরিপুর, গুতমা ও পূর্ববাগ গ্রামে লুট–অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গোলাম রসুল মাস্টার হত্যা – খালাস
১২) মধ্য আগস্টে মাধবপুরের জগদীশপুর হাই স্কুলে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে মাজেদাকে ধর্ষণ – মৃত্যুদন্ড
১৩) ১৮ই আগস্ট চুনারুঘাটের নরপতি গ্রামের তিনজনকে হত্যা – যাবজ্জীবন কারাদন্ড
১৪) ২৯শে সেপ্টেম্বর মাধবপুরের মৌজপুর গ্রাম থেকে চারজনকে অপহরণ ও সোনাই নদীর তীরে হত্যা – যাবজ্জীবন কারাদন্ড
১৫) অক্টোবরে শাহজীবাজার বিদ্যুত কেন্দ্রে একজনকে নির্যাতন ও হত্যা – খালাস
১৬) ১৫ই নভেম্বর ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসিরনগরের ২২টি গ্রামে ১০৮জন হিন্দুর গনহত্যা, লুট ও অগ্নিসংযোগ – মৃত্যুদন্ড

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.