বাংলাদেশে সশস্ত্র জঙ্গীবাদের ঘটনা ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়মিত দেখা গেলেও ২০০৬ সালের পর বড় একটি ছেদ পড়ে। কেননা তখন তিনটি বড় সংগঠনের–আল-কায়েদাপন্থী হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি), জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি)–প্রধান নেতারা গ্রেপ্তার হন এবং দ্রুত কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
English version: Jamaat-backed AQIS jihadists out to eliminate Awami League, hit India
এসব দলের নেতারা ছিলেন মূলত আফগানযুদ্ধ ফেরত মুজাহিদ এবং দেওবন্দ অনুসারী মাদ্রাসার শিক্ষক। আর অপারেশনে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মাদ্রাসা বা কলেজের ছাত্ররা। আর তাদের টার্গেট ছিল আওয়ামীলীগ ও বামপন্থী দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, এনজিও, শিয়া, আহমদীয়া ও অমুসলিমরা। বড় ধরণের হামলায় জঙ্গীরা মূলত গ্রেনেড ও আইইডি এবং ব্যক্তিকে আঘাতের জন্য চাপাতি ও ছুরি ব্যবহার করতো।
হুজি-বি ও জেএমবি অকার্যকর হয়ে পড়ায় তাদের অনুসারীরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ ও সদস্য বাড়াতে কাজ করে। ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ছাত্র ও শিক্ষককে রিক্রুট করা হয়। গঠন করা হয় নতুন কয়েকটি দল। এছাড়া জেএমবির সর্বোচ্চ নেতা সালাহউদ্দিনকে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে মুক্ত করার পর তিনি সেই দলের ভার নেন।
২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা হিজবুত তাহরীর দল হিসেবে সরাসরি অপারেসশনে অংশ না নিলেও তাদের মূল কাজ ছিল অন্যান্য সংগঠনের জিহাদি কার্যক্রমে সমন্বয়ক ও কারিগরি সহযোগিতা দেয়া এবং সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মগজ ধোলাই করা।
১/১১ সরকারের সময় হুজি-বি’কে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিলেও প্রথম আলোসহ আমেরিকান দূতাবাসের চাপে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। তখন হিজুদের হাত ধরেই আল-কায়েদার নতুন দলটি কাজ শুরু করে এবং ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিডিআরের কতিপয় সদস্যদের দিয়ে জঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানের মূল নায়ক তথা সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তাদের বিডিআর দ্বারা হত্যা করায়।
তার দুই বছরের মাথায়, ২০১১ সালে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে হিজুরা আবার সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং সাবেক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ অনেকেই বরখাস্ত হয়।
এরই মধ্যে ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সরকার ১৫ই আগস্টের ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর করার পর বেপরোয়া হয়ে উঠে জামায়াত ও জঙ্গীরা।
একই বছর হিজুদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ভার্সিটি পড়ুয়া জঙ্গীরা ইয়েমেনে আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির সাথে দেখা করে সহযোগিতা চায়। সেসময় ব্রিটেনে থাকা জঙ্গী রাজীব করিম জাওয়াহিরির নির্দেশে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে বোমা হামলার পরিকল্পনা করে গ্রেপ্তার হয় এবং ১০ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়।
২০১১ সালের জুনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন করা হলে হিজু, জেএমবি, হুজি, জামায়াত ও হেফাজতসহ সকল ইসলামী দল প্রতিবাদ শুরু করে। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা দেখেছি ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে হেফাজতের ১৩ দফা আন্দোলনে সব ইসলামী দল ও মুখোশধারী জঙ্গীদের বিভিন্ন সমাবেশে।
উল্লেখ্য, এসব ইসলামী দল নির্বাচন করুক বা না করুক, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।
আর তাই ২০১৩ সালের শুরুতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের বিচার কাজ শেষদিকে চলে আসায় জিহাদের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে গদিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় এরা। আর ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠা হলে আন্দোলনকারীদের ইসলামের শত্রু ও ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে খুনের রাজনীতি শুরু করে জামায়াত-হেফাজত ও তাদের সমমনা দলের নেতা-কর্মীরা। সেই সন্ত্রাসে মদদ দেয় জামায়াতের মালিকানার পত্রিকা আমার দেশ ও নয়া দিগন্ত।
১৩ই জানুয়ারি সেক্যুলার ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের উপর চাপাতির আক্রমণ দিয়ে শুরু করে এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারি আরেক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার বা থাবা বাবাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে জঙ্গীরা। এর পরের তিন বছরে আরও অন্তত ১১টি অপারেশনে ৯ জনকে হত্যা করে দায় স্বীকার করে আল-কায়েদার পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী দল আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ। জানা যায় এদের বাংলাদেশ শাখার নাম আনসার আল ইসলাম। একই কায়দায় একই মতাদর্শের আরও ৭ জনকে হত্যা করে এরা, তবে দায় স্বীকার করেনি।
প্রতিটি ঘটনায় ভিকটিমদের বিরুদ্ধে নবী-রাসুলকে কটুক্তি ও বিভিন্ন অনৈসলামিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ দিত জঙ্গীরা।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি প্রথিতযশা সেক্যুলার লেখক, গবেষক ও শিক্ষক অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরই আনসার আল ইসলাম আসিফ মহিউদ্দিনের উপর হামলার পর সব হত্যার দায় নেয়। তার আগে টুইটারে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের একটি নতুন সংগঠন সেসবের দায় স্বীকার করেছিল। আনসার আল ইসলামের দায় স্বীকারের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম আর শোনা যায়নি। সে সময় গোয়েন্দা পুলিশ বিদেশী জঙ্গী দল আনসার আল ইসলামের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল এবং জঙ্গীদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী অনেক সেক্যুলার ব্লগার ও লেখককে গ্রেপ্তার করেছিল। আবার এই তালিকা ধরেই যখন খুন করা হচ্ছিল সরকার তখন ছিল নির্বিকার। ফলে বেশিরভাগ ঘটনায় সঠিক তদন্ত হয়নি, বিচারও হয়নি।
কিছু হত্যার ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়া খুনিদের পরিচয় দেখা যায় তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্র যারা হিজবুত তাহরীর, ইসলামী ছাত্র শিবির এবং হেফাজতে ইসলামের সাথে যুক্ত।
একইভাবে ২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেটের নামে হত্যাকান্ড চালানো জঙ্গীদলের কথাও অস্বীকার করেছিল গোয়েন্দারা।
আনসার আল ইসলাম তাদের সর্বশেষ অপারেশনে এলজিবিটি অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে হত্যার পর অনলাইনে জনসমর্থন বাড়াতে মনোযোগ দেয়। এছাড়া তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় কক্সবাজারকেন্দ্রিক জিহাদি কার্যক্রমে যুক্ত হয়, যা তাদের পূর্বসূরী হুজি-বি ও জেএমবি করতো।
জিহাদি বই, অনলাইন ফোরাম ও গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে হিজু, আনসার আল ইসলাম, হুজি-বি এবং জেএমবির জঙ্গীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। তবে জামায়াত-শিবির ও হিজুরা ছাড়া আর কোন জঙ্গী দল তাদের সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যে এখনও স্বীকার করেনি।
দায় স্বীকার করা খুনের তালিকা
১/ ২০১৩ সালের ১৩ই জানুয়ারি ঢাকার উত্তরায় আসিফ মহিউদ্দিনের উপর চাপাতি হামলা। মারাত্মক আহত এই ব্লগার পরবর্তীতে বিদেশে চলে যান।
২/ ১৫ই ফেব্রুয়ারি পল্লবীতে রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে হত্যা।
৩/ ২০১৪ সালের ১৪ই জুন ঢাকার শ্যমলীতে রাকিব মামুন গুলিবর্ষণে আহত।
৪/ ৩০শে সেপ্টেম্বর সাভারে জাহানঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের পাশে নিজের বাসায় ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশরাফুল আলমকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা।
৫/ ১৫ই নভেম্বর রাজশাহী বিসশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লালনভক্ত অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকে চাপাতি দিয়ে হত্যা।
৬/ পরের বছর ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের কাছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে, আহত হন তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ।
৭/ এর এক মাসের মাথায় ৩০শে মার্চ তেজগাঁয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় অফিসে যাওয়ার সময় চাপাতির আঘাতে মারা যান ওয়াসশিকুর রহমান বাবু। এসময় কয়েকজন হিজড়া ব্যক্তি দুই খুনিকে ধরে ফেলে। এরা হেফাজতের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র বলে জানা যায়।
৮/ একই বছর ১২ই মে সিলেটের রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাসকে।
৯/ এরপর ৭ই আগস্ট ঢাকার গোড়ানে নিজের ফ্ল্যাটে চাপাতি হামলায় নিহত হন ব্লগার নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নীলয় নীল)।
১০/ ৩১শে অক্টোবর ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের অফিসে চাপাতির আঘাতে খুন হন প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন। তার বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্প্রতি বাংলা একাডেমির নতুন সভাপতি হল।
১১/ একই দিন লালমাটিয়ায় শুদ্ধ্বস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিমের উপর চাপাতি হামলা হয়। এতে সকলেই মারাত্মক হন।
১২/ এরপর ২০১৬ সালের ৬ই এপ্রিল পুরান ঢাকার সুত্রাপুরের রাস্তায় চাপাতি হামলায় নিহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ।
১৩/ একই বছর ২৫শে এপ্রিল কলাবাগানে নিজের বাসায় চাপাতি হামলায় নিহত হন এলজিবিটি অধিকার কর্মী ও ইউএসএইডের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়।
একই ধরণের অন্যান্য হামলা
১/ সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় নেতা জগৎজ্যোতি তালুকদারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হয় ২০১৩ সালের ২রা মার্চ।
২/ এরপর ৯ই এপ্রিল বুয়েটের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপকে চাপাতি দিয়ে হামলা করে হেফাজত ও শিবিরের কর্মীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২রা জুলাই তিনি মারা যান।
৩/ বুয়েটের আরেক ছাত্র তন্ময় আহমেদ মুনের উপর ২০১৩ সালের ১১ই আগস্ট চাপাতি হামলা হয় গাইবান্ধায়।
৪/ এরপর ৯ই ডিসেম্বর বগুড়ার কলেজ শিক্কষক ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগটঠক জিয়া উদ্দিন জাকারিয়াকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
৫/ ২০১৪ সালের ১৫ই অক্টোবর ঢাকার মনিপুর স্কুলের একজন শিক্ষককে চাপাতি দিয়ে খুনের চেষ্টা করতে গিয়ে তিন জঙ্গী গ্রেপ্তার হয়।
৬/ শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সংগীত শিক্ষক রিয়াদ মোরশেদ বাবুকে সাভারের পালপাড়ার বাসায় চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি।
৭/ ২০১৫ সালের ১১ই জানুয়ারি চট্টগ্রামের নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলী দেবী চৌধুরীকে চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.